আলমগীর হোসেন,নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
দ্রোহের কবি,প্রেমের কবি,অগ্নিবীণার কবি,সাম্যের কবি,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ময়মনসিংহের ত্রিশাল। ১৯১৪ সালে অসাম্প্রদায়িক কিশোর নজরুলকে ত্রিশালে নিয়ে আসেন আসানসোলে কর্মরত কাজীর শিমলা গ্রামের দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ।ভর্তি করে দেন ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলের (বর্তমান সরকারি নজরুল একাডেমি) সপ্তম শ্রেণিতে।ত্রিশালের পরতে পারতে মিশে আছে বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য। ত্রিশাল যেন নজরুলেরই নামান্তর। ত্রিশাল জুড়ে শুধু নজরুলেই জয় জয়াকার।এখানকার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নাম নজরুলকে চিরঞ্জীব করে রেখেছে।বিদ্রোহী কবি স্মৃতি বিজড়িত এই ত্রিশালকে নিয়ে লিখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেন।
নজরুলপ্রেমী, সাহিত্য ও কবিতাপ্রেমীদের ভ্রমণতালিকার শীর্ষে থাকে ময়মনসিংহের ত্রিশাল। নজরুলের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও ভ্রমণপিয়াসীদের তৃষ্ণা মেটানোর যথেষ্ট দর্শনীয় স্থান ত্রিশালে রয়েছে। একদিনের ত্রিশাল ভ্রমণে যা যা দেখবেন-
কাজীর শিমলার নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র: কবির স্মৃতি রক্ষার্থে কাজীর শিমলা গ্রামে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই স্মৃতিকেন্দ্রটি। এখানে ঢুকেই দেখা যাবে নজরুল পাঠাগার। নজরুলের নিজের হাতে লেখা বই, নজরুলকে নিয়ে রচনা, সমালোচনা এবং গবেষণা প্রবন্ধের বিশাল সমাহার রয়েছে এখানে। নজরুলের গানের রেকর্ডও আছে। নজরুল যে ঘরটিতে ছিলেন সেটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষবাগান, যার প্রতিটি গাছের নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের কবিতা-গানে উল্লিখিত গাছগুলোর নামে। নজরুলের ব্যবহৃত খাট, গোসলের পুকুরও আছে সংরক্ষিত। যে বটগাছের নিচে বাঁশি বাজাতেন কবি, সুযোগ হবে সেটিও দেখার। সৌভাগ্য থাকলে চোখে পরবে এখানে মাঝেমধ্যে বসা কবি সাহিত্যিকদের আসর।
বিচ্যুতিয়া ব্যাপারীবাড়ির নজুরুল স্মৃতিকেন্দ্র: কবি নামাপাড়ার ব্যাপারীবাড়িতে জায়গীর থাকতেন। কাজীর শিমলার স্মৃতিকেন্দ্রটির সাথে এটিও একই সময়ে নির্মাণ করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় স্মৃতিকেন্দ্রটি নির্মিত। এখানে কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি যাদুঘর, লাইব্রেরী এবং অডিটরিয়াম নির্মান করা হয়েছে। যাদুঘরে কবির স্বহস্তে লিখিত বেশ কিছু দুর্লভ পান্ডুলিপি, কবির ব্যবহৃত কিছু দুস্প্রাপ্য সামগ্রী এবং কবির কর্মময় জীবনের বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এই স্থানটি শুধুমাত্র নজরুল গবেষক-ই নয় সাধারণ মানুষের জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। দেশ বিদেশের খ্যাতিমান নজরুল গবেষক, শিল্পীগণ এবং তদুপরি দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ এই কেন্দ্রটি ভ্রমনে এসে বেশ কিছু গাছের চারা রোপন করেছেন। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে।
সরকারি নজরুল একাডেমি স্কুল : কিশোর নজরুলকে এনে এই স্কুলেই ভর্তি করান রফিজউল্লাহ দারোগা।ত্রিশাল বাসষ্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমী (সাবেক দরিরামপুর হাই স্কুল) এখানে কবি ৭ ও ৮ম শ্রেনিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখে ছিলেন ‘আমি এক পাড়া গাঁয়ে স্কুল-পালান ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুজেঁ পাওয়া যাবেনা। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই, আজও জল তেষ্টা পেয়ে যায়’। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাস রুম ও দেয়ালে এই কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে।প্রবেশ করা মাত্রই নজরে আসবে বিশাল মাঠ। এই স্কুলমাঠেই প্রতিবছর আয়োজিত হয় নজরুল জন্মজয়ন্তী। স্কুল মাঠের পাশেই ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে নজরুল মঞ্চ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেষ্ট হাউজ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়: কবির স্মরণে তার স্মৃতিবিজরিত শুকনি বিলের বটতলাতে ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। কবি নজরুল ছোট বেলায় এই বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন।নজরুল স্মৃতি বিজড়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া এলাকায় অবস্থিত একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।এখানে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি জুড়ে রয়েছে নজরুলের আনাগোনা। পুরনো দুটি আবাসিক হলের নাম – অগ্নিবীণা ও দোলনচাঁপা। ক্যাফেটেরিয়ার নাম চক্রবাক। মেডিকেল সেন্টারটির নাম ব্যথার দান। বাসগুলোরও নামকরণ করা হয়েছে কবির সাহিত্যকর্মের নামে। রয়েছে জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু ও নজরুল ভাষ্কর্য। এখানকার প্রতিটি ইট পাথর প্রতিনিয়ত যেন নজরুলকেই প্রতিনিধিত্ব করছে।
চেচুয়া বিল: ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে অবস্থিত লাল শাপলার বিল। প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তীর্ণ এ বিলটিতে লাল শাপলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ দেখা মেলে সাদা ও বেগুনি শাপলা। সাথে ভাসমান কচু ফুলের সাদা আভা এখানকার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। প্রকৃতির এই সম্মোহনী রূপ যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর মনে দোলা দিয়ে যায় মূহুর্তেই। গোটা বিলের বুক জুড়ে মৌসুমের সময় লাল শাপলার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রঙ-বেরংয়ের শাপলার বাহারি রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।যতদুর চোখ যায় তার পুরোটা জুড়েই লাল শাপলার রক্তিম নান্দনিকতার মনোলোভা রূপ। সকালে উদিত সূর্যের আভায় ফুটন্ত লাল শাপলা ও পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্তের দৃশ্য মুহূর্তে যে কারো মন কাড়ে। এমন সৌন্দর্য বিরাজ করছে ত্রিশালের চেচুয়া বিলে। প্রকৃতিতে নিজের রূপ বৈচিত্র অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে জলাভূমি ও বিলে ফুটে থাকা এ জলজ ফুলের রানি। শাপলা ফুলের উপস্থিতিতে যেন প্রাণ ফিরেছে গ্রামের শিশুদের উচ্ছ্বল মাখা শৈশব। জলের উপর বিছানো সবুজ পাতা ভেদ করে হাসে লাল একেকটি শাপলা। দেখলে মনে হয় লাল শাপলা যেন রঙের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে বিলজুড়ে।
ত্রিশালে যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে মাত্র ১০৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ত্রিশাল। রেলপথ ও সড়কপথ দুই উপায়েই যাওয়া যায় ত্রিশালে। রেলপথে আসলে ১৬০-২৫০ টাকা খরচ হবে। ময়মনসিংহ স্টেশনে নেমে লোকাল বাস বা সিএনজিতে ত্রিশালে আসতে পারবেন। সড়কপথে ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি ত্রিশাল আসা যায়। ভাড়া লাগবে ২৫০-৩৫০ টাকা।
